বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বর্তমানে গর্ভস্থ শিশুর বাড়ন্ত সময়ও ধাপে ধাপে পরিলক্ষণ করা যায়। গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রজনন অঙ্গ গুলির স্বাস্থ্য, তিনটি ত্রৈমাসিক জুড়ে শিশুর বৃদ্ধি, ভ্রুণের হার্ট ও গর্ভকালীন অবস্থা বোঝার জন্য একটি নির্ণায়ক পদ্ধতি হচ্ছে আল্ট্রাসনোগ্রাফি। এই আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন হচ্ছে একটি বিশেষ যন্ত্র, যা আল্ট্রাসাউন্ড জেলের দ্বারা গর্ভবতী নারীর গর্ভের ভিতরের অবস্থা দেখার জন্য আল্ট্রাসোনিক ওয়েভ ব্যবহার করা হয়।
আমাদের আজকের এই পুরো আর্টিকেলটি সাজানো হয়েছে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় সহ গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসাউন্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পুরো আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন। তো চলুন দেরি না করে জেনে আসি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় সম্পর্কে।
toc) #title=(Table of Content)
আলট্রাসনোগ্রাফি কি
আল্ট্রাসনোগ্রাফি হচ্ছে শরীরের ভিতরের অংশের এক ধরনের ছবি দেখার পরীক্ষা। অনেকসময় একে আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা, সনোগ্রাম অথবা আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানও বলা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষায় বিশেষ এক ধরনের শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের ভিতরের অংশের ছবি তোলা হয়। ‘প্রোব’ নামক ছোট ও ভোঁতা যন্ত্রের সাহায্যে বিশেষ হাই ফ্রিকোয়েন্সী শব্দ তরঙ্গ তৈরি করা হয়। এই প্রোবটি শরীরের নির্দিষ্ট স্থানের সংস্পর্শে নেওয়ার মাধ্যমে সেই অংশের ছবি দেখা যায়। আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষার সময় কম্পিউটারের স্ক্রিনে যে ছবিটি ভেসে ওঠে এবং পরবর্তীতে তা প্রিন্ট করা হয় তাকেই মূলত আলট্রাসনোগ্রাম বলে।
আরো পড়ুনঃ উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ব্যায়াম
আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায়
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় - আমরা অনেকেই আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর বুঝতে পারি না যে রিপোর্টের মধ্যে কিভাবে কি আছে। আপনি আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর যেভাবে বুঝবেন রিপোর্টে কি আছে তা হচ্ছে -
- আপনার আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টে গর্ভের ছবিটি দেখুন। যখন আপনার রিপোর্টে গর্ভের ছবিটি দেখবেন, ছবিটির কোণগুলোর চারপাশে একটি হালকা ধূসর বা সাদা লাইন দেখতে পাবেন। এবং একটি বড় কালো অংশ দেখতে পাবেন যা অ্যামনিওটিক তরল নামে পরিচিত।
- এই বড় কালো অংশে অর্থাৎ অ্যামনিওটিক তরলের মধ্যে আপনার শিশুকে ধূসর অথবা সাদা রঙের দেখাবে।
- আপনার গর্ভাবস্থার প্রথম ৪ সপ্তাহের আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টে আপনার গর্ভস্থ ভ্রুণটিকে একটি সিদ্ধ শিমের আকার ও আকৃতির মতো দেখাবে।
- এবং আপনি যদি আপনার ১২ সপ্তাহের আল্টাসাউন্ড রিপোর্ট দেখেন তবে, আপনার শিশুর মাথাটি দেখতে পাবেন।
- ২০ সপ্তাহের আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টে যা দেখতে পাবেন তা হচ্ছে, আপনার গর্ভস্থ শিশুর চোখ, হার্ট, শিরদাঁড়া ও পা ও দেখতে পাবেন। এবং তখন চাইলে আপনি আপনার গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ ও জানতে পারবেন।
আরো পড়ুনঃ রাত জেগে স্মার্টফোন ব্যবহারে কি কি ক্ষতি হয়
গর্ভাবস্থায় করা ৫ প্রকারের আল্ট্রাসাউন্ড
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় -। বর্তমানে আপনার বাড়ন্ত গর্ভের আল্ট্রাসোনিক স্ক্যান করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অনেক উন্নতি হয়েছে। গর্ভাবস্থায় করা আল্ট্রাসাউন্ড প্রধানত ৫ ধরনের হয়, যেমন-
১. ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসাউন্ড:
ট্র্রান্সভ্যাজাইনাল কথার অর্থ হচ্ছে, যোনির মধ্যে দিয়ে। উচ্চ ঝুকিপূর্ণ অথবা জটিল সমস্যা থাকলে এই স্ক্যানটি করা হয় গর্ভবতী মহিলাদের। সাধারণত এটি ভ্রুনের বয়স ১০ সপ্তাহের কম হলে এটি করা হয়।
২. ফিটাল ইকোকার্ডিওগ্রাফি:
আল্ট্রাসাউন্ডে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে, যেমন-গর্ভস্থ শিশুর হার্টে কোনো ত্রুটি বা সমস্যা আছে কিনা তা দেখার জন্য সাধারণত এই স্ক্যানটি করানো হয়।
৩. সাধারণ আল্ট্রাসাউন্ড:
সাধারণত এই ধরনের আল্ট্রাসাউন্ডে টেকনিশিয়ান আপনার গর্ভস্থ শিশুর 2ডি ছবি দেখার জন্যে একটি লাঠির আকারের ট্রান্সডিউসার পেটের উপর চালান।
৪. 3-ডি আল্ট্রাসাউন্ড:
একটি বিশেষ ট্রান্সডিউসারের দ্বারা করা হয় এই সোনগ্রাফিটি। যা দ্বারা করা হয় আপনার গর্ভস্থ শিশুর সম্পূর্ন ছবি ও বিস্তারিত তথ্য প্রদান করা।
৫. ডায়নামিক 4ডি আল্ট্রাসাউন্ড:
এটি অনেকাংশে 3ডি আল্ট্রাসাউন্ডের মতোই। শুধুমাত্র পার্থক্য হচ্ছে, এটার ক্ষেত্রে আপনি আপনার গর্ভস্থ শিশুর নড়াচড়া দেখতে পারবেন এবং অনেক ক্ষেত্রে এটার একটি ভিডিও রেকর্ডিং ও পেতে পারেন।
আরো পড়ুনঃ লেবু দিয়ে ওজন কমানোর উপায়
আলট্রাসনোগ্রাফি করালে কি গর্ভের শিশুর ক্ষতি হতে পারে
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় - আলট্রাসনোগ্রাফি পরিক্ষা করার ফলে এখন অব্দি গর্ভবতী নারী ও গর্ভস্থ শিশুর কোনো প্রকার ক্ষতি হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় নি। বরং গর্ভকালীন সময়ে এই পরিক্ষা করানো নিরাপদ। আলট্রাসনোগ্রাফি পরিক্ষায় কোনো ধরনের ক্ষতিকর রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় না। এক প্রকার উচ্চ মাত্রার শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের অংশের ছবি তোলা হয়। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা করা উচিত নয়।
আরো পড়ুনঃ খালি পেটে লেবু খেলে কী হয়
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট কি ভুল হয়
কখনো কখনো ভ্রুনের অবস্থান ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য, নানান সমস্যার কারণে আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে পুরোপুরি পরিষ্কার ছবি পাওয়া সম্ভব হয় না। এর জন্য সবসময় আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট ১০০% সঠিক নাও হতে পারে। আপনার গর্ভের ১০ থেকে ১৪তম সপ্তাহের পরে যদি আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে আপনি গর্ভের শিশুর ডেলিভারির তারিখ বের করার চেষ্টা করেন,তবে এক্ষেত্রে সঠিক ফলাফল নাও পেতে পারেন। সময় অনুযায়ী আপনার চিকিৎসকই আপনাকে ডেলিভারির তারিখ জানিয়ে দিবেন।
কিছু ক্ষেত্র বিশেষ রয়েছে যার কারনে অনেক সময় আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট হুবুহু সঠিক নাও হতে পারে। যেমন-
- গর্ভবতী নারীর ওজন অথবা পেটে চর্বির পরিমান বেশি থাকলে।
- গর্ভের বাচ্চাকে তার চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা অ্যামনিওটিক তরল, এর পরিমাণ বেশি হলে।
- পেটে কোনো ধরনের জটিল কাটা দাগ বা সেলাই থাকলে।
- গর্ভের শিশুটি সুবিধাজনক অবস্থানে না থাকলে।
আরো পড়ুনঃ মধু খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা
শেষ কথা
গর্ভকালীন সময় আল্ট্রাসাউন্ড বিভিন্ন কারণে করা হয়ে থাকে। পাঁচ ধরনের আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমেই গর্ভবতী নারী ও গর্ভস্থ শিশুর স্বাস্থ্য এবং প্রজনন অঙ্গগুলোর বিভিন্ন পরিক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। তারপরও যদি উপরের তথ্য মোতাবেক আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টটি পরিষ্কার না বোঝেন, তবে অবশ্যই আপনার গাইনী চিকিৎসকের সাহায্য নিতে পারেন।
আমাদের আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনি জানতে পারলেন, আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় সহ আল্ট্রাসাউন্ডের বিভিন্ন অজানা তথ্য। আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় এই পুরো পোস্টটি এতক্ষন মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। গর্ভকালীন সময় বাইরে খুব বেশি যাতায়াত না করাটাই ভালো। তারপরও প্রয়োজনে বের হলে কোনো প্রকার তাড়াহুড়ো না করে সর্তকার সহিত চলাফেরা করবেন। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন। ধন্যবাদ।
আরো পড়ুনঃ মেছতা দূর করার ১০টি উপায়
আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট বোঝার উপায় সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর / FAQ
প্রশ্ন ১: আল্ট্রাসনোগ্রাম করলে বাচ্চা ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় কিনা?
উত্তর:- সর্বক্ষেত্রে আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে শিশুর লিঙ্গ উল্লেখ করা থাকে না। আপনার গর্ভের সন্তান ছেলে না মেয়ে তা জানতে হলে, আল্ট্রাসনোগ্রাম করানোর ঠিক আগে আপনার আল্ট্রাসনোগ্রামের যে ডাক্তার তাকবেন তাকে জানান। কিছু রিপোর্টে মেয়ে শিশুর ক্ষেত্রে gender/sex এর জায়গায় female অথবা xx লেখা থাকে এবং ছেলে শিশুর ক্ষেত্রে male অথবা xy লেখা থাকে।
প্রশ্ন ২: আল্ট্রাসনোগ্রাম ছাড়াই শিশুর মাথা নিচু হওয়ার লক্ষণ।
উত্তর:- যদি আপনার শিশু মাথা নিচু করে এবং আপনার পিঠের দিকে মুখ করে থাকে (OA অবস্থায়) তবে আপনি সম্ভবত আপনার পাঁজরের নিচে লাথি অনুভব করবেন। আপনি আপনার গর্ভস্থ শিশুর পিঠের শক্ত গোলাকার পৃষ্ঠটিও অনুভব করতে পারবেন,যা আপনার পেটের এক পাশে থাকবে।
প্রশ্ন ৩: গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসনোগ্রাফি কি ক্ষতিকর?
উত্তর:- আপনার গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আল্ট্রাসাউন্ড করা আপনার এবং আপনার গর্ভস্থ শিশুর জন্য নিরাপদ। যেহেতু আল্ট্রাসাউন্ড বিকিরণের পরিবর্তে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে। এটি এক্সরে থেকে নিরাপদ। আল্ট্রাসনোগ্রাফি প্রদানকারীরা ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আল্ট্রাসাউন্ড ব্যবহার করছেন। এবং তারা তার কোন বিপদজনক ঝুঁকি খুঁজে পাননি।
প্রশ্ন ৪: বাচ্চার অবস্থান কিভাবে বুঝব?
উত্তর:- পেলভিস বা পিউবিক হাড়ের উপরের অংশে আঙুলের ডগা দিয়ে মৃদু চাপ প্রয়োগ করুন। আপনি যদি কিছু কঠিন অনুভব করেন তবে সম্ভবত এটি মাথা। যদি অঞ্চলটি নরম হয় তবে এটি সম্ভবত ভ্রূণের নীচের অংশ।
প্রশ্ন ৫: জন্মের সময় বাচ্চার অবস্থান কি হওয়া উচিত?
উত্তর:- সিফালিক প্রেজেন্টেশনে শিশুটি মাথা নিচু করে, চিবুক বুকের সাথে টেনে নেয়, মায়ের পিঠের দিকে মুখ করে। সাধারণত একটি গর্ভস্থ শিশুর এই অবস্থান মসৃনতম প্রসবের জন্য অনুমতি দেয়। কারণ শিশুর জন্মের সময় শিশুর মাথা সহজেই জন্মের খালের নিচে এবং পিউবিক হাড়ের নিচে যেতে পারে।
প্রশ্ন ৬: গর্ভাবস্থার লক্ষণ কত দিন পর প্রকাশ পায়?
উত্তর:- গর্ভাবস্থার হরমোনগুলো ১ থেকে ২ সপ্তাহে বৃদ্ধি পায় এবং তার সাথে সম্পর্কিত প্রাথমিক লক্ষণগুলোও হতে পারে, যেমন - মাথা ব্যাথা, ফোলাভাব, ক্লান্তি। ১ থেকে ২ সপ্তাহে শরীর রক্ত উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যার ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, ক্লান্তি এবং নিম্ন রক্তচাপ সহ গর্ভাবস্থার প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দেয়।